
বই পর্যালোচনা –
শাহিদা পারভীন রেখার তিন কাব্যগ্রন্থ : মানুষের জীবন, প্রকৃতি ও অনুভূতির এক অনন্ত অনুসন্ধান-
বাংলা কবিতার বিস্তৃত আকাশে এমন কিছু স্বর আছে, যাদের উচ্চারণে মানুষ, প্রকৃতি, শ্রম, স্বপ্ন-সব মিলেমিশে এক অবিনশ্বর মানবচেতনার ছবি আঁকে। কবি শাহিদা পারভীন রেখার কাব্যভুবন সেই স্বরগুলোর অন্যতম শুদ্ধতম রূপ। তার কবিতায় মানুষ শুধু একটি শব্দ নয়- এটি শ্রম, সংগ্রাম, ভালোবাসা, আর প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সহাবস্থানের এক মহিমান্বিত দ্যোতনা। চাষির ঘামে-ভেজা জমি থেকে যে ধান উঠে আসে, তা শুধুই খাদ্য নয়-তা হলো একটি জাতির অস্তিত্ব, আনন্দ ও স্বপ্নের স্থায়ী প্রতীক। তাঁর প্রথম গ্রন্থ “ক্ষুধার আনন্দ” সেই কৃষকসমাজের জীবনগাথা- যেখানে নবান্ন, পিঠা-পুলি, পরিশ্রম, হাসি-কান্না সব মিলিয়ে ধান আর মানুষ যেন এক দেহে পরিণত হয়েছে। এই কাব্যের কবিতাগুলো পড়লে মনে হয়-মাটির নীচে দানা বাঁধা ধানের অঙ্কুর থেকে যেন ভাষা জন্ম নিচ্ছে, আর কবি কেবল তাকে কাগজে তুলে দিচ্ছেন অত্যন্ত সহজ অথচ মহিমান্বিত ভাষায়।
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “অনুভূতির আর্তনাদ” যেন তার বিস্তারে আরেক ধাপ গভীরে ঢোকে। এখানে কবি মানুষের অন্তর্জগতকে পাঠকের সামনে উন্মুক্ত করেন। প্রকৃতি, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, সামাজিক বাস্তবতা, স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ-সব মিলিয়ে এই কাব্যগ্রন্থ মানবচিন্তার এক অন্তর্লোক। কবির শব্দে অনুভূতি শুধু প্রকাশ পায় না-এগুলো যেন মর্মে গিয়ে ফাটল তোলে, প্রশ্ন জাগায়, আবার শান্তিও দেয়।
তৃতীয় গ্রন্থ “বসন্ত তোমার দ্বারে / Spring To You”-তে কবির কাব্যচেতনা আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রবেশ করে। বাংলা ভাষার রস নিয়ে লেখা এই কবিতাগুলোর ইংরেজি রূপান্তর পাঠককে অন্য এক দৃষ্টিভঙ্গি দেয়- যেখানে বাংলার কৃষি, ঋতু, প্রকৃতি, সংস্কৃতি বিশ্বমানবতার ভাষায় এসে দাঁড়ায়। “Late Autumn” কবিতার মতো রচনায় হেমন্ত যেন শুধু একটি ঋতুর নাম নয়—এটি পরিশ্রমী মানুষের স্বপ্নফসল, যা জীবনকে তার সত্যিকার সৌন্দর্য ও সংগ্রামেরূপে তুলে ধরে।
এই তিন কাব্যগ্রন্থ মিলিয়ে শাহিদা পারভীন রেখার কাব্যকর্মকে যেভাবে দেখা যায়, তা হলো-একজন নারী লেখকের অবিরাম আত্মগঠন, মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, কৃষিভিত্তিক বাংলার চিরন্তন সৌন্দর্য, এবং স্বাধীনতার প্রগাঢ় দর্শন। এতটুকু বললে তাঁর সাহিত্যসাধনার পূর্ণ পরিচয় দেয়া হয় না। তিনি শুধু কবি নন-তিনি একজন আবৃত্তিশিল্পী, জীবনের দীর্ঘ সময় যিনি কৃষিসংযোগ আর মানুষের উন্নয়নে অতিবাহিত করেছেন। মাটির সঙ্গে তাঁর পেশাগত সম্পর্কই তাঁর কবিতাকে দিয়েছে অনন্য এক স্বাদ-যে স্বাদ পাকা ধানের গন্ধের মতো, যা মানুষের অন্তর স্মৃতি জাগিয়ে তোলে।
স্বাধীনতা কবিতাটি তাঁর মননজগতের সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত-যেখানে স্বাধীনতা কোনো রাজনৈতিক শব্দ নয়; এটি মানুষের অন্তর্লোক, মানুষের মর্যাদা, ভাষার সম্মান, ও বাঙালির আত্মপরিচয়কে আলোকিত করার সংগ্রামী শক্তি। এই কবিতায় তিনি স্বাধীনতার প্রতীক খুঁজে পান প্রেমে, নির্মলতায়, স্বপ্নে, মানুষের গভীরতম আকাঙ্ক্ষায়।তাঁর জীবনের প্রতিটি স্তরে-গ্রামের শেকড়, কৃষি গবেষণায় নিয়োজিত নিষ্ঠা, মা ও পরিবারে তাঁর ভূমিকা, সাংস্কৃতিক চর্চা, দীর্ঘ কর্মজীবনে পাওয়া সম্মাননা, এবং শেষত হজ্জ পালনের আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা-সবকিছু মিলেই তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে অভিজ্ঞতার আলোয় উজ্জ্বল।
কবি শাহিদা পারভীন রেখার তিনটি গ্রন্থকে একসাথে পড়লে বোঝা যায়-তিনি কেবল কবিতা লেখেন না;
তিনি মানুষের জীবনকে পড়েন, প্রকৃতিকে শোনেন, ইতিহাসকে অনুভব করেন, আর জীবনকে তাঁর ভাষায় উপলব্ধির নতুন সত্যে পরিণত করেন। বাংলা কবিতার ভুবনে তাঁর কাজ নিঃসন্দেহে এক আলোকরেখা- যা পাঠকের মনে মানুষ, প্রকৃতি ও অনুভূতির প্রতি নতুন করে ভালোবাসা জাগিয়ে তোলে।
—-মাঈন উদ্দীন —-
লেখক,সংগঠক ও সমাজকর্মী